শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য ও বৈষম্যের অভিযোগ নতুন নয়। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক বাংলাদেশকে বিশ্বে প্রতিযোগিতার উপযোগী করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। অনেক অভিভাবক গুণমানসম্পন্ন বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য নানা কষ্ট সহ্য করতে রাজি, কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষা একটি পণ্য নয়, কিন্তু ব্যবস্থা যেন তা করে রেখেছে।
মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে সন্তানকে বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে অনেক অভিভাবক বিপাকে পড়ছেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস মন্তব্য করেছেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মালিক ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের জন্য অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তিনি সরকারকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যের কারণে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা পদ সৃষ্টির এবং শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য দূর করার দাবি জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রতিকার আশা করলেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে অনেক শিক্ষক ক্লাসরুমের বাইরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হলেও শিক্ষকের পদ বাড়ানো হয়নি, যার ফলে দুই-তিনজন শিক্ষক দিয়েই পুরো কলেজ পরিচালনা করতে হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করছে।
অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি ব্যবস্থা অনুসৃত না হওয়ার কারণে শিক্ষকরা পিছিয়ে পড়ছেন। বেতন স্কেলের উপর ভিত্তি করে ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ গ্রেড কর্মকর্তাদের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকারি কলেজগুলোতে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে এবং শিক্ষকের পদ সৃজন অপরিহার্য। অথচ বর্তমানে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার, এবং ১২,৪৪৪টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আটকে আছে দীর্ঘ এক দশক ধরে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলেন, দেশে এমপিওভুক্ত, ননএমপিওভুক্ত এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বৈষম্য শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা দাবি করেছেন, জাতীয়করণের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন।
শিক্ষাবিদরা বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শ্রেণি বৈষম্য তৈরি করছে, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা ধনী পরিবারের সন্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের খরচ অনেক কম, তবে মানের প্রশ্ন রয়েছে। সরকারি বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হলেও, গুণমানসম্পন্ন বেসরকারি বিদ্যালয়ের খরচ অনেকের জন্য বহন করা কঠিন।
বর্তমানে ঢাকা মহানগরে সরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এর ফলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল অভিভাবকদের সন্তানদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকায় অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ের মাসিক বেতন ৫ হাজার টাকার উপরে, এবং কিছু ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ১০ হাজার টাকার বেশি। এই সমস্যা শুধু ঢাকা নয়, অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও বিদ্যমান।
ছয়টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও বাস্তবিক পরিবর্তন খুবই সামান্য। সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে নাজুক। শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে বই সরবরাহ করা হলেও, তা যথেষ্ট নয়। ১৯৯১ সালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আইন হলেও, তার বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়।
বৈষম্য দূর করতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কল্যাণ সমিতির নেতারা মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এবং বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দেবিদ্বার উপজেলা বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মানববন্ধন করেছেন। তাঁরা মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানান।