একসময় শুধু সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো। আর এখন বেসরকারি খাতের ব্যাংক নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। এর বড় কারণ, রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর বড় ক্ষতি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের চেয়ে পলিসি বা নীতির দায় অনেক বেশি।
দেশের আর্থিক খাত বর্তমানে যে অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, তাতে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ বা সংকট ব্যবস্থাপনা সবার আগে জরুরি। আশা করি, নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ সেই কাজ করছেন। এতে হয়তো তিন থেকে ছয় মাস লাগবে। তবে একই সঙ্গে টেকসই আর্থিক খাত নিয়েও ভাবতে হবে।
গত এক দশকে করপোরেট সুশাসনের কাঠামোয় অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। এ সময়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবর্তন হয়েছে স্বজনতোষী ও ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা কাজ করতে পারবে, তা দেখার বিষয়। তবে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক লোকজন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আসেন এবং নানা খারাপ চর্চা করেন। আবার এক যুগ ধরে মালিকদের মধ্য থেকে চার-পাঁচজন করে পরিচালনা পর্ষদে থাকা এবং টাকা সরিয়ে নিতে যোগসাজশ করা—এমন চিত্রও দেখেছি। এসব বিষয়ে একটা সমাধানে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকারদেরও দায় রয়েছে।
ব্যাংক খাতে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সংস্কার করতে হলে করপোরেট সুশাসনের কাঠামোকে ঠিক করতে হবে। তার জন্য উপযুক্ত সময় এখনই। ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ব্যাংক খাতের ক্ষতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাত কখনোই ঘুরে দাঁড়াবে না।
খেলাপি ঋণ আমাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, তা এ মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা আপনি কোথায় দেখাবেন। ফলে খেলাপি ঋণের বিষয়টি ঠিক করা না গেলে মুদ্রানীতিতে অসামঞ্জস্য তৈরি হবে। বর্তমানে যে ১০-১২ শতাংশ খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই খেলাপি ঋণের পরিমাণ পরিষ্কার করে জানানো প্রয়োজন। এটি বের করার জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। আর শুধু খেলাপি ঋণের পরিমাণ নয়, এসব ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে, সেটিও দেখতে হবে। তবে এটাও ঠিক খেলাপি হলেই তাকে খারাপ বলা যাবে না; দেখতে হবে সেটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে।
বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও সংস্কার জরুরি। রাষ্ট্রীয় সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও (এফআইডি) যুক্ত থাকে। আমি মনে করি, এভাবে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চলতে পারে না। সব সিদ্ধান্ত এক জায়গা থেকে আসা উচিত। সে ক্ষেত্রে এফআইডি নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নিয়ে কাজ করতে পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অবস্থানের সঙ্গে বড় কোনো দ্বিমত নেই। তবে এটুকু বলব, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে যেতে হবে। তবে ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য কিছুটা সুযোগও রাখতে হবে।