শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গত ৫ আগস্ট গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্র মো. ইয়াসির সরকার (১৮)। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুসনদ পায়নি পরিবার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাছের কুতুবখালীর প্রধান সড়কে ইয়াসির গুলিবিদ্ধ হন। নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন ইয়াসির। বাসা রাজধানীর শনিরআখড়ার গ্যাস রোড এলাকায়। গত সোমবার শনিরআখড়ার বাসায় বসে কথা হয় ইয়াসিরের বাবা মো. ইউসুফ সরকারসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে।
ইউসুফ সরকার জানালেন, ৫ আগস্ট রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ছেলের লাশ পান তাঁরা। লাশের সঙ্গে একটি টোকেন ছিল। রক্তমাখা কাগজের টোকেনে ছেলের নামের বানান ভুল করে ‘ইয়াছিন সরকার’ লেখা ছিল। বয়স লেখা ছিল ২৪ বছর। মৃত্যুর সময় উল্লেখ ছিল বেলা ৩টা ৪০ মিনিট। ছেলের মৃত্যুর প্রমাণ হিসেবে এই টোকেনটা তাঁদের কাছে আছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুসনদ পাননি তাঁরা। ছেলের মৃত্যুসনদ পাওয়ার জন্য গত ২১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন তিনি।
ইউসুফ সরকার বলেন, সেদিন রাতে লাশ আনতে গেলে মর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া নেওয়া যাবে না। এই প্রক্রিয়ার জন্য থানা থেকে লিখিত আনতে হবে। কিন্তু সে রাতে কোনো থানায় পুলিশ ছিল না। তখন তাঁদের লাশ রেখে চলে যেতে বলা হয়। কিন্তু ছেলের লাশ মর্গে ফেলে কীভাবে তাঁরা বাড়ি চলে আসবেন? তাই ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে চলে আসেন। তখন ছেলের মৃত্যুসনদ তাঁদের দেওয়া হয়নি। ছেলের শরীরে একাধিক গুলির চিহ্ন ছিল। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ আছে। তারপরও মৃত্যুসনদ পেতে ঘুরতে হচ্ছে বলে অভিযোগ এই বাবার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তাঁর অবর্তমানে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন উপপরিচালক চিকিৎসক মো. নূরুল ইসলাম। তিনি আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুসনদ দিতে হলে ময়নাতদন্ত করা বাধ্যতামূলক। তবে আন্দোলনের সময়কার পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। অনেকেই তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে গেছেন। এমন একাধিক ঘটনা আছে। এসব ক্ষেত্রে করণীয় বিষয় তাঁরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
ক্যানসারের রোগী ইউসুফ সরকারের একটি টেইলার্সের দোকান ছিল শনিরআখড়ায়। কিন্তু ছেলের মৃত্যু ও নিজের বর্তমান শারীরিক অবস্থার কারণে এই দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।
ইয়াসিরসহ তিন ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা ইউসুফ সরকার। তাঁর বড় দুই ছেলে চাকরি করছেন। তিনি নিজে দীর্ঘদিন বিদেশ ছিলেন। জমানো টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন।
ইয়াসির বয়সে ছোট হলেও মা–বাবাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন। ছোট বোনকে মাদ্রাসায় আনা-নেওয়া করতেন। বাসার বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন। মাঝেমধ্যে সাইকেল চালিয়ে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যেতেন। এভাবেই ছেলের নানা কাজের স্মৃতিচারণা করছিলেন বাবা ইউসুফ সরকার।
৫ আগস্টের কথা উল্লেখ করে ইউসুফ সরকার বলেন, ‘সেদিন দিবাগত রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় ফিরি। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখছি, পুলিশ পাখির মতো মানুষকে গুলি করে মেরেছে।’
ইয়াসিরের বড় বোন হাফসা বুশরা জানালেন, তাঁর ভাই আন্দোলন থেকে ফিরে নানা গল্প শোনাতেন। নিজে কী করতেন, তা বলতেন। এত সাহস দেখানোর জন্য তিনি ভাইকে বকাও দিয়েছিলেন। উত্তরে ভাই বলেছিলেন, ‘সবাই ভয় পেয়ে পেছনে চলে গেলে হবে নাকি?’
ইয়াসির পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন না। তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন ছাত্র-জনতাকে যেভাবে মারা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাতে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইয়াসিরের আন্দোলনে যাওয়াটা পছন্দ করতেন তাঁর মা বিলকিস আক্তার। তাই আন্দোলনে যাওয়ার আগে তা তিনি তাঁর মাকে জানাতে চাইতেন না। মা ফোন দিলে বলতেন, বাসার কাছেই আছেন, দ্রুত চলে আসবেন।
গত ৪ আগস্টও ইয়াসির আন্দোলনে গিয়েছিলেন। সেদিন হাতের আঙুলে ব্যথা পেয়ে বাসায় ফিরেছিলেন তিনি। সেদিন মা বিলকিস আক্তার নিজেই ছেলের হাতে বরফ ও মলম লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছেলেকে আর আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন।
বিলকিস আক্তার বললেন, ‘ছেলেকে বলেছিলাম, আঙুলে একটু ব্যথা পেয়েই তোমার কত কষ্ট হচ্ছে। যাঁরা আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু হচ্ছে, তাঁদের কেমন কষ্ট হচ্ছে বলো? তুমি আর আন্দোলনে যেয়ো না।’
ইয়াসির মাকে বলতেন, আন্দোলনে গিয়ে মারা গেলে তো শহীদ হবেন। এ কথা শুনে মা বলেছিলেন, যাঁরা শহীদ হন, তাঁরা তো চলেই যান। কিন্তু তাঁদের মা-বাবাকে সারাজীবন এই কষ্ট বুকে নিয়ে বেড়াতে হয়।
এখন এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন বিলকিস আক্তার-ইউসুফ সরকার দম্পতি।
৪ আগস্ট রাতেও ইয়াসির মা–বাবা, ভাই-বোনকে ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যেতে অনুরোধ করেছিলেন।
৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিলকিস আক্তার ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে দোকান থেকে আটা আর চিনি আনতে পাঠান। চিনি-আটা নিয়ে ঘরে ফিরে ছেলে মায়ের কাছে লেবুর শরবত খেতে চান।
সকালে নাশতা না করে শুধু শরবত খেয়ে দুপুর ১২টার দিকে ইয়াসির ঘর থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় মা তাঁকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। ইয়াসির মাকে বলেছিলেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন না।
বিলকিস আক্তার বলেন, ছেলে আন্দোলনে যেত, তাই ভয়ে একটু পরপর তাঁকে ফোন দিতেন তিনি। ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে ছেলে ফোন ধরত। কিন্তু সেদিন বেলা তিনটার পর থেকে ছেলে আর ফোন ধরেছিল না।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন—এ খবরে ততক্ষণে বিভিন্ন এলাকায় আনন্দমিছিল বের হয়। ইয়াসিরের পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো মিছিলে আছেন। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেলেও ইয়াসির বাসায় ফিরছেন না দেখে সবার মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।
বোন হাফসা বুশরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে আমি ফেসবুকে ভাইয়ের ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দিই। কেউ খোঁজ পেলে জানানোর অনুরোধ করি। সেই পোস্টে অনেকেই হাসপাতালে খোঁজ নিতে বলছিলেন। কেউ কেউ বিভিন্ন লাশের ছবি পাঠিয়ে জানতে চাচ্ছিলেন, এটা আমার ভাই কি না। লাশের ছবি পাঠানোতে তখন রাগ হচ্ছিল।’
হাফসা বলেন, ‘রাত প্রায় ১১টার দিক একজন ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে একটি ছবি পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, এইটা আমার ভাই কি না। ছবি দেখে মানতে চাচ্ছিলাম না যে এইটাই আমার ভাই। বড় ভাইয়াকে ছবি দেখিয়ে বললাম, এটা তো ইয়াসির। ছবি পাঠানো আপুর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, আমার ভাইয়ের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আছে।’
হাফসা বলেন, ‘মর্গে গিয়ে ভাইকে দেখে মনে হলো, আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভাইয়ের গালে স্পর্শ করে দেখলাম, একদম ঠান্ডা হয়ে আছে। হাতও একদম শক্ত। ইয়াসির বলে ডাকলাম, যদি আমার ভাই আমার ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু না, ভাই আমার ডাকের সাড়া দিল না। বুকের একপাশে গুলির চিহ্ন। অন্যপাশে ব্যান্ডেজ। পেছনে কোনো গুলি আছে কি না, দেখার জন্য কাত করতেই পিঠ থেকে অনবরত রক্ত বের হতে থাকে। বুকের দুই পাশে দুইটা, কোমরের মাঝ–বরাবর পেছনের দিক থেকে একটা—মোট তিনটা গুলি করা হয়েছে।’
হাফসা জানালেন, ৫ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনের মেঝেতে বেশ কয়েকজনের লাশ পড়ে ছিল। সেখান থেকে একজন লাইভ ভিডিও করছিলেন। এই ভিডিও থেকেই স্ক্রিনশট নিয়ে তাঁদের কাছে ছবি পাঠানো হয়েছিল। পরে তাঁরা এই ভিডিও দেখেন। অনেকগুলো লাশের মধ্যে তাঁর ভাইয়ের লাশ দেখতে পান।
হাফসা বলেন, ‘আপনজনের এমন ভিডিও চোখে দেখা যায় না। তবে এই ভিডিও ও ফেসবুকে এক আপু আমার ভাইয়ের ছবি না পাঠালে তাঁকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে যেত। এই ভিডিওই এখন সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে।’
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মা বিলকিস আক্তার বলেন, ‘ছেলেটা শুধু স্মৃতি রেখে গেছে। ভাত ছাড়া আর সব খাবার তাঁর পছন্দের ছিল। এখন যে খাবারেই হাত দিই, তাই দেখি ওর পছন্দের ছিল। ৪ তারিখেও ছেলে শার্টের একটি পিছ পছন্দ করে আসছিল। আর ৫ তারিখে তো ছেলেই নাই। নতুন একটা প্যান্ট কিনছিল, তা–ও পরা হলো না।’