পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিকতার স্পর্শ, বিশ্বায়নের স্বপ্ন তখনো অনেকের কাছে ছিল কল্পনা। নাটক–সিনেমা, গানবাজনার প্রচার–প্রসারও সেভাবে ছিল না। আর যেটুকু যা ছিল, সেখানে মেয়েদের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না বললেই চলে। ‘নারী অভিনেত্রী’র চরিত্রের প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন, পত্রপত্রিকা সূত্রে এমনও খবরও পাওয়া যায়। এই যখন পরিস্থিতি তখন কলেজপড়ুয়া একজন তরুণীর নিজের কলেজে মঞ্চস্থ হওয়া শরৎচন্দ্রের দেবদাস নাটকে অভিনয় করার কথা শোনা যায়। তিনি আর কেউ নন, জনপ্রিয় অভিনেত্রী রওশন জামিল।
ঢাকার রোকনপুরে ১৯৩১ সালের ৮ মে তাঁর জন্ম। শৈশব থেকেই নাচ–গান ভালোবাসতেন। ঘর থেকেই শুরু করেছিলেন চর্চা। তবে শুরুটা এতটা সহজ ছিল না। কারণ, ওই সময়ে একজন মেয়ের নাচ শেখা আজকের মতো এতটা সহজ ছিল না। নানা ঘাত–প্রতিঘাত, দ্বিধা—দ্বন্দ্ব বাধা হয়ে দাঁড়াত। যদিও তাঁদের বাড়িতে ওই সময়ে গানবাজনার চল ছিল। তবে তা ছিল একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে, নিজেদের মধ্যে। বাড়িতে সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করলেও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থাকার জন্য তাঁকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তিনি কেবল নাচ দেখতেন। পরে বাড়ি এসে সেগুলো অনুশীলন করতেন। এভাবেই নাচ শিখতে থাকেন তিনি। জানা যায়, একদিন স্কুলের এক অনুষ্ঠানে একজন নৃত্যশিল্পী (শিক্ষার্থী) অনুপস্থিত থাকায় তাঁর নাচার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু মাকে রাজি করাতে হবে? অনেক জোরাজুরি করলে মা রাজি হন। কিন্তু নিজের নামের পরিবর্তে তাঁকে ওই শিক্ষার্থীর নামে নাচ করতে হয়। তারপরও নাচার স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় খুশি হন তিনি। পরে অবশ্য তাঁর বিপুল আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা বাড়িতে নাচের শিক্ষক রেখেছিলেন। কিন্তু তা–ও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। রওশন জামিলের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থাকার স্বপ্ন হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত, যদি না গওহর জামিলের সঙ্গে তাঁর দেখা হতো। ঘটনাটা বলি, তখন তিনি তাঁর ছোট বোন মমতাজকে নাচের স্কুলে নিয়ে যেতেন। আর এখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় গওহর জামিলের।
পরবর্তী সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন দুজনে। স্বামী গওহর জামিল তাঁকে উৎসাহ দেন। তাঁর তত্ত্বাবধানেই পুনরায় তিনি নাচ শিখতে শুরু করেন। শিল্প–সংস্কৃতির সঙ্গে থাকার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে স্বাবলম্বী হওয়ারও প্রেরণা ছিল রওশন জামিলের মধ্যে।
নিজে সব সময় কিছু না কিছু করতে চাইতেন। ওই সময়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাবে, এমন ভাবা সহজ ছিল না। এই ভাবনার প্রতিফলনও ব্যক্তিজীবনে রেখেছেন তিনি। মেয়েদের এগিয়ে যেতে হবে, এই ভাবনা থেকেই তিন মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের ভর্তি করেছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল দুই ছেলের পড়ালেখার খরচ। সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে গিয়েছিল। তাই নাচের পাশাপাশি রেডিও নাটকে কাজ শুরু করেন রওশন জামিল। তারপর একসময় রেডিও থেকে নাম লেখান টেলিভিশন নাটকে। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মনের মতো বউ’ সিনেমা দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। পরের বছর কাজ করার সুযোগ পান জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে। এই সিনেমা তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি শেখ নিয়ামত আলী, আমজাদ হোসেন, ঋত্বিক কুমার ঘটকের মতো নির্মাতাদের ছবিতেও অভিনয় করেন। রওশন জামিলের চরিত্রগুলো ছিল সমাজের চেনা। বাঙালি পরিবারের ‘কুটিল’ চরিত্রেই তাঁকে দেখা যেত।
পাশাপাশি ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছেন এই অভিনেত্রী। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে। ‘নয়নমণি’ ও ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ ছবি দুটিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্বচরিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া একুশে পদকসহ নানা পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রে তাঁর করা খল চরিত্রগুলোর ধারা এখনো বহমান।
তাঁর অভিনয় এতটাই বাস্তব ছিল যে বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে দর্শকেরা তাঁর ওপর চড়াও হতেন। পরে তাঁদের বুঝিয়ে রক্ষা পেতেন যে তিনি তো পরিচালকের কথামতো অভিনয় করতেন! বাস্তব জীবনে রওশন জামিল ছিলেন মিশুক ও সাদামনের মানুষ। তিনি হাসিমুখে সবার সঙ্গে মিশতেন। ‘নারীরা কাজ করবে, স্বাবলম্বী হবে, পুরুষের পাশে এগিয়ে চলবে’, এমন স্বপ্ন দেখতেন তরুণ বয়স থেকে। নিজের জীবনে সেই ভাবনারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মেয়েদের বলতেন, ‘জীবনটা এত সোজা নয়। তোমাদের প্রতে৵ককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। জীবন তোমাদের নিজেদের হাতে।’ ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘নয়নমণি’, ‘জননী’, ‘মাটির ঘর’সহ অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন রওশন জামিল। জিতে নিয়েছেন সু–অভিনেত্রীর খেতাব। ২০০২ সালের ১৪ মে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। চার দশকের ক্যারিয়ার দিয়ে তিনি আজও যেমন সিনেমাপ্রেমীদের কাছে অমর হয়ে আছেন। তেমনি নারীদের জন্যও রেখে গেছেন এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।