একজন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। আরেকজনও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পেসার। আইপিএলে দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। বিশেষ করে প্রথমজন, সাকিব আল হাসান। মোস্তাফিজুর রহমানও আইপিএলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ করেছিলেন অন্য মাত্রা। কিন্তু এবারের আইপিএল নিলামের পর প্রশ্নটি উঠেই যাচ্ছে। সাকিব ও মোস্তাফিজের আইপিএল ক্যারিয়ার কি তবে শেষ? গতকাল নিলামে যে মোস্তাফিজকে কেনেনি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি দল। আর সাকিবের নাম নিলামে তোলাই হয়নি।
অথচ বাংলাদেশের আইপিএল দর্শকেরা চোখ রেখেছিলেন নিলামে। এবার বাংলাদেশের মোট ১২ জন ক্রিকেটার জায়গা পেয়েছিলেন আইপিএলের মেগা নিলামে। তাঁদের মধ্যে সাকিব-মোস্তাফিজ দল পেতে পারেন বলে মনে করেছিলেন বাংলাদেশের অনেক দর্শক। যেহেতু অতীতে তাঁরা আইপিএলে সফলতা পেয়েছেন, তাই এবারও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর তাঁদের প্রতি আগ্রহ থাকবে—এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের দর্শকদের ভাবনার সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর নীতিনির্ধারকদের ভাবনা মেলেনি।
৩৭ বছর বয়সী সাকিব এখন আবুধাবি টি১০ লিগে বাংলা টাইগার্সের হয়ে খেলছেন। বাংলা টাইগার্সের এই অধিনায়ক এ পর্যন্ত ২টি ম্যাচ খেলেছেন। স্যাম্প আর্মির বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচে ১৫ রানে নেন ২ উইকেট। নিউইয়র্ক টাইগার্সের বিপক্ষে গত শনিবার ব্যাটে-বলে দারুণ করেন। ১২ বলে ১৯ রানের পর বোলিংয়ে ১ ওভারে ১ রানে নেন ২ উইকেট। দেশের হয়ে সর্বশেষ খেলেন গত মাসে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টে। মাত্র ১ কোটি রুপি ভিত্তিমূল্য হওয়ার পরও এবার আইপিএলে তাঁকে না নেওয়ার একটা কারণ হতে পারে, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের দলীয় সমন্বয়ে সাকিবের জায়গা খুঁজে পায়নি।
এবার নিলামে মোস্তাফিজের ভিত্তিমূল্য ছিল ২ কোটি রুপি। তাঁকেও সম্ভবত সমন্বয়ের মধ্যে না পড়ায় আগ্রহ দেখায়নি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি দল। এ বছর টি-টোয়েন্টিতে দেশের হয়ে ১৮ ইনিংসে ২৭ উইকেট নেওয়া মোস্তাফিজের ইকোনমি রেট ৭.৫৮। গড় ১৯.১১ ও স্ট্রাইক রেট ১৫.১। বেশ ভালো পারফরম্যান্স করার পরও মোস্তাফিজকে কেন কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি দল নিল না, সেটি একটি প্রশ্ন হতে পারে। তবে গত মাসে ভারতের মাটিতে তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজে মোস্তাফিজের পারফরম্যান্স তেমন ভালো ছিল না। ৩ ম্যাচে ৬৬টি বল করে ৪ উইকেট নিলেও দিয়েছিলেন ১২৪ রান। ইকোনমি রেট ছিল ১১.২৭! ভারতের মাটিতে এই সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স মোস্তাফিজের ওপর থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণও হতে পারে।
অথচ একসময় পরিস্থিতি এমন ছিল না। ২০১৬ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে দারুণ পারফরম্যান্সের পর সে বছরই প্রথম আইপিএলে ডাক পান মোস্তাফিজ। ১ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তাঁকে কিনেছিল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। ফ্র্যাঞ্চাইজিটির সেবার প্রথম শিরোপা জয়ে ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন মোস্তাফিজ। হয়েছিলেন পঞ্চম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। জিতেছিলেন সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। পরের বছরও সানরাইজার্সে থাকলেও চোটের কারণে খেলেছিলেন মাত্র ১ ম্যাচ। ২০১৮ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস তাঁকে কেনে ২ কোটি ২০ লাখ রুপিতে।
২০১৩ আইপিএলে চোটের কারণে একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি সাকিব। কিন্তু কলকাতা তাঁকে ধরে রেখেছিল ২০১৪ আইপিএলে ২ কোটি ৮০ লাখ রুপিতে। সেবার আইপিএলে দারুণ করেন সাকিব। ১৩ ম্যাচে ১১ ইনিংসে ব্যাট করে ৩২.৪৩ গড়ে করেছিলেন ২২৭ রান। বোলিংয়ে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট।
মোস্তাফিজ সে মৌসুমে ৭ ম্যাচে ৭ উইকেট নিলেও ওভারপ্রতি গড়ে ৮.৩৬ করে রান দিয়েছিলেন। ২০১৯ ও ২০২০ সালে আইপিএলে মোস্তাফিজকে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ১৪ ম্যাচে ওভারপ্রতি গড়ে ৮.৪১ করে রান দিলেও নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট। সেবার তাঁকে ১ কোটি রুপিতে কিনেছিল রাজস্থান।
২০২২ ও ২০২৩ আইপিএলে মোস্তাফিজ খেলেছেন দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে। এ দুটি মৌসুমেই তাঁকে ২ কোটি রুপিতে কিনেছিল দিল্লি। সেখানে দুটি মৌসুম মিলিয়ে ১০ ম্যাচ খেলে ৯ উইকেট নেওয়া মোস্তাফিজ সেভাবে ছাপ ফেলতে পারেননি। গত মৌসুমে চেন্নাই সুপার কিংস তাঁকে ২ কোটি রুপিতে কিনেছিল। ৯ ম্যাচ খেলে গত মৌসুমে ১৪ উইকেট নিয়ে বেশ ভালো করলেও ওভারপ্রতি গড়ে রান দেন একটু বেশি—৯.২৬। আইপিএলে সব মিলিয়ে ৫৭ ম্যাচে ৬১ উইকেট নিয়েছেন মোস্তাফিজ। ওভারপ্রতি গড়ে রান দিয়েছেন ৮.১৪।
সাকিবের আইপিএল-যাত্রা শুরু ২০১১ সালে। সেবার কলকাতা তাঁকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ডলারে কিনেছিল। সেবার ৭ ম্যাচে ওভারপ্রতি গড়ে ৬.৮৬ রান দিয়ে ১১ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ১৩১.৮১ স্ট্রাইক রেটে রান করেছিলেন ২৯। পরের মৌসুমে ৮ ম্যাচে ১২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ৯১ রান করে কলকাতার প্রথম শিরোপা জয়ে ভালোই ভূমিকা ছিল সাকিবের। ফাইনালে চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে ৭ বলে ১১ রানের কার্যকর ‘ক্যামিও’ ইনিংস খেলেছিলেন। তার আগে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ম্যাচে ১৭ রানে ৩ উইকেট নেওয়া এখনো আইপিএলে তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং।
২০১৩ আইপিএলে চোটের কারণে একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি সাকিব। কিন্তু কলকাতা তাঁকে ধরে রেখেছিল ২০১৪ আইপিএলে ২ কোটি ৮০ লাখ রুপিতে। সেবার আইপিএলে দারুণ করেন সাকিব। ১৩ ম্যাচে ১১ ইনিংসে ব্যাট করে ৩২.৪৩ গড়ে করেছিলেন ২২৭ রান। বোলিংয়ে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। কলকাতার হয়ে দ্বিতীয় আইপিএল ট্রফিরও দেখা পেয়েছিলেন সেবার। সাকিব এরপর আইপিএলে আরও তিন মৌসুম খেলেন কলকাতার হয়ে—২০১৫, ২০১৬, ২০১৭; প্রতিবারই তাঁকে ২ কোটি ৮০ লাখ রুপিতে রেখেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি দলটি। এই তিন মৌসুমে মোট ১৫ ম্যাচ খেলে ১৫১ রান করার পাশাপাশি ৯ উইকেট নেন।
২০১৮ সালে ২ কোটি রুপিতে সাকিবকে কেনে কলকাতা। সে মৌসুমে ১৭ ম্যাচে ২৩৯ রান করার পাশাপাশি উইকেট নিয়েছিলেন ১৪টি। তবে ব্যাটিংয়ে প্রত্যাশা তেমন পূরণ করতে পারেননি। সেই ১৪ ম্যাচের মধ্যে ৯ ম্যাচেই ব্যাট করেন ৫ নম্বরে। সেবার সেই পজিশনে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৭.২২, স্ট্রাইক রেটও ১১০-এর কম। সব মিলিয়ে ২১ গড়ে ২৩৯ রান—সানরাইজার্সের প্রত্যাশা তেমন একটা পূরণ করতে না পারলেও পরের মৌসুমের জন্য ২ কোটি রুপিতে তাঁকে ধরে রেখেছিল সানরাইজার্স। সেবার ৩ ম্যাচ খেলে ৯ রানের পাশাপাশি নেন ২ উইকেট। সাকিব সর্বশেষ খেলেছেন ২০২১ আইপিএলে। সেবার কলকাতা তাঁকে ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতে কিনলেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। ৮ ম্যাচে করেছিলেন ৪৭ রান। বোলিংয়ে নেন ৪ উইকেট। আইপিএলে সব মিলিয়ে ৭১ ম্যাচে ৭৯৩ রান করার পাশাপাশি ৬৩ উইকেট নিয়েছেন সাকিব।