দ্যা নিউ ভিশন

নভেম্বর ২৬, ২০২৪ ১৮:৪২

সোনাদিয়ায় স্যান্ডউইচ গাঙচিলের উপস্থিতি

একটি স্যান্ডউইচ গাঙচিল। ২২ মার্চ কক্সবাজারের সোনাদিয়ার খড়ির চরেছবি: লেখক

সোনাদিয়ায় স্যান্ডউইচ গাঙচিলের সন্ধান

বাসের দেরি ও পথের জটিলতায় সকাল ৭টার বাস কক্সবাজার পৌঁছাল সাড়ে ৮টায়। এরপর নাশতা সেরে ঘাটে পৌঁছাতে আরও আধঘণ্টা সময় লাগে। সবকিছু পেরিয়ে স্পিডবোট ৯টা ৪০ মিনিটে ছাড়ল। যাত্রার ১৫ মিনিটের মাথায় বাঁকখালী নদীর মোহনায় প্রথম পাখি ‘সরুচঞ্চু গঙ্গাকৈতর’-এর দেখা পেলাম। তবে সে গল্প অন্য সময় হবে। আজ (২২ নভেম্বর) আমাদের লক্ষ্য ছিল আরও বিরল একটি পাখির সন্ধান। বার্ডিংবিডি ট্যুরস-এর তত্ত্বাবধানে মো. কামালের স্পিডবোটে আমরা সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের বেলেকেরদিয়া চরের দিকে রওনা হলাম।

ঘড়ির কাঁটায় যখন ১১টা বাজে, তখন বেলেকেরদিয়ার পাশের একচিলতে খড়ির চরে পৌঁছালাম। গত মার্চে এখানে অতি বিরল কালো-পা গঙ্গকৈতর এবং সেপ্টেম্বরে লেসার নডি পাখির দেখা পেয়েছিলাম। আজ এখানে আরও একটি বিরল পাখির খোঁজে এসেছি। ১৬ নভেম্বর, ব্রিটিশ পক্ষিবিদ গ্যারি অলপোর্ট এবং সুইডিশ পক্ষিবিদ জ্যান-এরিক নিলসেন প্রথমবারের মতো এই পাখিটির ছবি তোলেন। এই দেশের মাটিতে পাখিটি আগে মাত্র একবার দেখা গিয়েছিল, তাই পাখিটি দেখার আশায় আমাদের মিশন।

জোয়ার এসে যাওয়ার পর চরটি ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। প্রায় ৩১ মিনিট ধরে বাইনোকুলার দিয়ে চরটির আনাচকানাচে অনুসন্ধান চালালাম। যেখানে গাঙচিল দেখলাম, সেখানেই আরও খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে ১১টা ৩১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ওই যে পাখিটি, বড় খোঁপাযুক্ত গাঙচিলের পাশে।’ সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে পাখিটির দেখা পেলাম এবং ক্লিক করলাম। হঠাৎ পাখিটি উড়ে গেল, এবং আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ক্লিক করে গেলাম। বিরল ও নতুন একটি পাখি পেয়ে আনন্দে মনপ্রাণ ভরে উঠল।

সোনাদিয়ার খড়ির চরে দেখা পাখিটি ছিল এক অপ্রতুল ও অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি, স্যান্ডউইচ টার্ন। পাখিটির বাংলা নাম নেই, তাই আপাতত স্যান্ডউইচ গাঙচিল নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Thalasseus sandvicensis। ইংল্যান্ডের স্যান্ডউইচ শহরে প্রথম শনাক্ত হওয়ায় এর নামকরণ হয়েছে ওই শহরের নামানুসারে। পাখিটি ইউরোপে, বিশেষ করে ক্যাস্পিয়ান সাগরের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত উপকূলে প্রজনন করে এবং শীতে দক্ষিণ ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ন করে। একটি ছোট অংশ উত্তর-পশ্চিম ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও আসে।

এটি একটি কালো মাথাযুক্ত, ছোট খোঁপাযুক্ত মাঝারি আকারের গাঙচিল। এর সরু ও সোজা কালো চঞ্চুর হলুদ আগা বিশেষভাবে পাখিটিকে অন্যান্য গাঙচিল থেকে আলাদা করে। পাখিটির দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার, ওজন ১৮৬ থেকে ৩০৫ গ্রাম। প্রজননকালীন পাখিটির পিঠ ও ডানার ওপর ফ্যাকাশে ধূসর, কোমর ও চেরা লেজ সাদা, এবং দেহের নিচটা হালকা গোলাপি আভাসে সাদা। ডানা লম্বা ও চোখা, চোখ কালচে, পা ও পায়ের পাতা কালো। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপর সাদা-কালো আঁশের মতো দাগ থাকে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়।

পাখিটি গাছপালাবিহীন, নিচু তীরবর্তী দ্বীপের নুড়ি বা কর্দমাক্ত সৈকতে বংশবৃদ্ধি করে। শীতকালে বালুময় উপকূল, পাথুরে সৈকত, মোহনা, পোতাশ্রয় প্রভৃতিতে অবস্থান করে। এটি মূলত মাছ, বাইম, সার্ডিন, চিংড়ি ইত্যাদি খায় এবং ভাটার সময় সামুদ্রিক পোকামাকড় খায়। তাদের ডাকের শব্দ ‘কিয়ের-ইনক’, ‘ক্রিরিক’ বা ‘ক্রিক-ক্রিক’। ছানাগুলো উচ্চস্বরে ‘সুই-সুই-সই’ শব্দে ডাক দেয়।

প্রজননকাল মে থেকে জুন। এ সময়ে বালুময় সমুদ্র উপকূলে সামান্য গর্ত করে কলোনা বাসা বানায়, লতাপাতা, নুড়িপাথর ও শুকনো মল দিয়ে বাসা সাজায়। ডিম পাড়ে এক বা দুটি, সাদা ডিমে কালো দাগ থাকে। সাধারণত ২৫ দিনে ডিম ফুটে কালো ছোপযুক্ত সাদা বা হলদেটে ছানা বেরোয় এবং ২৮ থেকে ৩৫ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৩ থেকে ৪ বছর লাগে, আর আয়ুষ্কাল গড়ে ১২ বছর।

আ ন ম আমিনুর রহমান
পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ

রাজশাহীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অভিযোগে “চিকনা আক্কাস” নামে পরিচিত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অভিযোগে আক্কাস আলী (৫০)