দ্যা নিউ ভিশন

অ্যান্টার্কটিকায় আমি কবরের মতো গর্ত খুঁড়ে সেখানেই পুরো রাত কাটিয়েছি।

ক্যাম্পিং মানে সাধারণত তাঁবু খাটিয়ে বাইরে রাত যাপন করা। তবে তুষারাচ্ছন্ন অ্যান্টার্কটিকায় বাতাসের তীব্র গতির কারণে তাঁবু খাটানো সম্ভব নয়। তাই তাঁবুর পরিবর্তে বরফের মধ্যে কবরের মতো গর্ত খুঁড়ে রাত কাটানো হয়। সম্প্রতি এমনই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি জহির ইসলাম ফিরেছেন। তাঁর কাছ থেকে শোনা সেই অভিজ্ঞতার গল্প আপনাদের শোনাচ্ছি।**৯ নভেম্বর** – আজ অ্যান্টার্কটিকায় আমাদের নবম দিন। এবারের অভিযান নিয়ে আমরা সবাই উত্তেজিত, বিশেষ করে যখন এক্সপেডিশন লিডার ক্রিস ঘোষণা করলেন, ‘আজ রাতে আমরা ক্যাম্পিং করব।’

 

আমরা যে প্যাকেজে এসেছি তার নাম বেজক্যাম্প। এই প্যাকেজের আওতায় ১৩ দিন অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে বেড়ানো, ক্যাম্পিং, হাইকিং, কায়াকিংয়ের মতো কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে আমাদের আগের তিন দিনের ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনা বাতিল হয়েছিল। তাই আজ ক্রিসের ঘোষণায় আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

 

সন্ধ্যায় আমাদের জাহাজ নোঙর করা হলো মেলকিউ দ্বীপের কাছে। শেফ রালফ আর তার দল খাবারদাবার নিয়ে প্রস্তুত। আমরাও দ্রুত ডিনার সেরে ক্যাম্পিংয়ের প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। শাবল, বেলচা, স্লিপিং ব্যাগ, জুতাসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে ক্রিসের ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম। রাত নয়টার দিকে ক্রিসের ডাক এল, ‘দ্রুত তৈরি হন, আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ব।’

 

**রাত সাড়ে ৯টা** – আমরা সবাই জাহাজ থেকে নেমে জোডিয়াকে উঠে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে ক্রিসসহ কয়েকজন গাইড ছিল। কিছুক্ষণ পর আমরা মেলকিউ দ্বীপে পৌঁছাই। দ্বীপটিতে শত শত জেনটু পেঙ্গুইনের বাস। তারা আমাদের দেখে খুব একটা পাত্তা দিল না।

 

ক্যাম্পিংয়ের প্রধান কাজ শুরু হলো—শাবল দিয়ে বরফ খুঁড়ে গর্ত তৈরি করা। আমি স্কুলে স্কাউট দলের সক্রিয় সদস্য ছিলাম, তাই ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে তাঁবু খাটানোর কোনো সুযোগ নেই, বরফের মধ্যে কবরের মতো গর্ত খুঁড়ে থাকতে হবে।

 

প্রায় ৩০ মিনিট খাটুনির পর একটা যথেষ্ট আকারের গর্ত তৈরি করলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে খুঁড়তে খুঁড়তে টি-শার্ট পরেই কাজ শুরু করলাম। গর্ত তৈরি হয়ে গেলে স্লিপিং ব্যাগ বিছিয়ে বিছানা বানালাম। বালিশ বানালাম পায়ের মাকবুট জুতা দিয়ে। এরপর স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সতর্কতা অবলম্বন করছিলাম যেন ভেতরে বরফ না ঢোকে।

 

রাতের চারপাশে অন্ধকার, ওপরে তারাভরা আকাশ। পেঙ্গুইনদের কিছু হালকা শব্দ কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল, যেন টাইম মেশিনে করে হাজার বছর আগের পৃথিবীতে চলে এসেছি। আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এল।

 

পকেট থেকে এয়ারপড বের করে গান শুনতে লাগলাম। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ খসখস শব্দে ঘুম ভাঙল, দেখলাম একদল পেঙ্গুইন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তারা সামান্য দূরে গিয়ে পানিতে নেমে গেল। পেঙ্গুইনেরা রাতে দল বেঁধে কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানার উপায় নেই।

 

ক্যাম্পিংয়ে আসার আগে ভেবেছিলাম, বরফে থাকলে ঠান্ডায় জমে যাব, কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং গর্ত খুঁড়তে গিয়ে খাটুনি হওয়ায় ভালোই ঘুম হয়েছে।

 

ভোর চারটার দিকে গাইডদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। সবাইকে জাহাজে ফিরতে বলল। স্লিপিং ব্যাগ এবং অন্যান্য জিনিস গুছিয়ে গর্ত পূর্ণ করলাম। এবার জাহাজে ফেরার পালা।

 

এমনই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন জহির ইসলাম, যা হয়তো সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Related News

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সর্বশেষ