বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতির পূর্বাভাস ‘ঋণাত্মক’ করেছে বৈশ্বিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা মুডিস রেটিংস। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের ঋণমানও কমিয়েছে সংস্থাটি। গত সপ্তাহে আলাদা দুটি ঋণমান প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব মূল্যায়ন তুলে ধরে সংস্থাটি।
মুডিসের এই মূল্যায়ন নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কিছুটা দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, মুডিসের এই মূল্যায়নের ফলে বিদেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলোকে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মুডিস বিশ্বের প্রধান তিনটি ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের একটি। এ কারণে মুডিসের মূল্যায়নকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা। তবে মুডিসের এই মূল্যায়ন একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল বলে মনে করেন না তাঁরা। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে শুরু করে শ্রম পরিস্থিতি, নানা দাবিতে একের পর এক গোষ্ঠীর আন্দোলন, সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এসব অনিশ্চয়তা না কাটলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও সহজে দূর হবে না। তাই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক, নির্বাচনসহ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেসব পদক্ষেপ রয়েছে সেসব অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েছে, এটা আমাদের কারও অজানা নয়। ফলে মুডিসের এই মূল্যায়ন খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল না
জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামষ্টিক অবস্থার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েছে, এটা আমাদের কারও অজানা নয়। ফলে মুডিসের এই মূল্যায়ন খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল না। যেহেতু সবাই আগেভাগে বিষয়টি অনুমান করতে পারছিলেন, ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব যা পড়ার তা এরই মধ্যে পড়ে গেছে। এখন নতুন করে আর কোনো প্রভাব পড়ে কি না সেটাই দেখার বিষয়।’
জাহিদ হোসেন বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক, নির্বাচনসহ অন্যান্য খাতের অনিশ্চয়তাগুলো দূর করতে হবে। তাহলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও কেটে যাবে।
এদিকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমানোর মুডিসের মূল্যায়ন যথাযথ হয়নি বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা বলেছে, গণ–অভ্যুত্থানের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তা মুডিস রেটিংসে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার এ–সংক্রান্ত এক ব্যাখ্যায় ব্যাংক খাতের সংস্কার, ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ‘মুডিস শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের পর দেশের অর্থনীতির আরও ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করবে। তখন তারা সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি পরামর্শ করবে। এর ফলে সরকারের নেওয়া নীতি ও উন্নয়নের সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে তারা।’
আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মুডিসের মতো প্রতিষ্ঠান ঋণমান কমালে তা নতুন করে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও বিদেশি ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিতে পারে। সাধারণত এ ধরনের ঋণমানের প্রভাব বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, মুডিসের এই প্রতিবেদনের ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ঋণপত্রের বিপরীতে বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংককে যে নিশ্চয়তা সুবিধা দেয় সেটি পেতে নতুন করে সমস্যা বাড়তে পারে। আবার বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদহারও বেড়ে যাবে। বাধাগ্রস্ত হবে বিদেশি বিনিয়োগও। সামগ্রিকভাবে দেশের ঋণমান পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ব্যাংকগুলোকেও সেই দায়ভার নিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।