**ইউক্রেনে ‘রোবট যুদ্ধ’: ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় সরঞ্জামের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার**
ইউরি শেলমুক, যিনি ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা, ড্রোন সিগন্যাল জ্যামার তৈরির জন্য গত বছর একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েন। শুরুর দিকে তাঁর তৈরি সামরিক সরঞ্জামের চাহিদা ছিল সীমিত, তবে এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে ২,৫০০টি সরঞ্জাম তৈরি করছে এবং ক্রেতাদের অর্ডার পূরণের জন্য প্রায় ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
চাহিদার এই পরিবর্তন ঘটে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে, যখন রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। ওই সময় রুশ সেনারা ব্যাপকভাবে ড্রোন ও ভূমিমাইন ব্যবহার শুরু করলে ইউক্রেনীয় বাহিনী বাধাগ্রস্ত হয়। ইউক্রেনের কিয়েভ সরকারের অভিযোগ ছিল, রুশ বাহিনী লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত এবং ধ্বংস করতে ড্রোনের বিপুল ব্যবহার শুরু করেছে। ইউরি শেলমুক বলেন, “এমন সস্তা ও কার্যকর ড্রোনগুলো আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যত থামিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধের মাঠে এক নতুন ‘গেম চেঞ্জার’ এসে হাজির হয়েছে।”
ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম তৈরির শিল্প এখন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ২০২২ সালে রুশ আক্রমণ শুরুর পর, ইউক্রেনে নতুন ৮০০টি কোম্পানি গড়ে উঠেছে, যেগুলো সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। যুদ্ধের ১০০০ তম দিনে, অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর, এই শিল্প ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে, আকাশপথে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে ড্রোন দিয়ে হামলা চালাতে শুরু করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনও ড্রোনবিধ্বংসী প্রযুক্তি মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। সাইবার আক্রমণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহারও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেনের আইনপ্রণেতা হালইয়ানা ইয়ানচেঙ্কো বলেন, “বর্তমানে ইউক্রেনের সামরিক শিল্প বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগতিতে বেড়ে চলা খাত।”
এ বছর, ইউক্রেন ও রাশিয়া মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ড্রোন তৈরি করছে, যার বেশিরভাগই ছোট আকারের এবং লক্ষ্যমাত্রা শনাক্ত এবং ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি ড্রোনের খরচ মাত্র কয়েক শ ডলার, যা যুদ্ধের খরচের তুলনায় অনেক কম।
ইউক্রেনের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরি শেলমুকের প্রতিষ্ঠান ‘আনওয়েভ’। তাদের প্রযুক্তি ড্রোনের সিগন্যাল ব্লক করে দিতে পারে এবং সেই সঙ্গে ড্রোনের কম্পিউটার সিস্টেমও বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম।
**’রোবট যুদ্ধ’ এবং ভবিষ্যৎ কৌশল**
রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়, পাশাপাশি যুদ্ধক্লান্তির হারও অনেক কম। ইউক্রেনের বাহিনী তাদের ক্ষয়প্রাপ্ত ইউনিটগুলো পুনরায় পূর্ণ করার জন্য প্রযুক্তির উপর নির্ভর করছে। অন্যদিকে, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার সেনারা ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দানে রুশ বাহিনীর হয়ে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে।
আগামী বছর, যুদ্ধের কাজে স্বয়ংক্রিয় বা রোবটিক সিস্টেমের ব্যবহার আরও বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্ভাবন হতে পারে। ইউক্রেনের রাষ্ট্র-সমর্থিত প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ব্রেভওয়ান’ জানায়, দেশটিতে এখন ১৬০টিরও বেশি কোম্পানি যুদ্ধে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় বা মানববিহীন যানবাহন তৈরি করছে। এসব যানবাহন রসদ সরবরাহ, আহতদের সরিয়ে আনা এবং দূরনিয়ন্ত্রিত মেশিনগান বহনসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুদ্ধের এই নতুন যুগে, যেখানে রোবট এবং ড্রোনদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেটি আগামী দিনের সংঘাতের একটি বড় চিত্র হয়ে উঠতে পারে।