অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও (রূপরেখা) পাওয়া যাবে। নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। তবে সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
আজ রোববার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথাগুলো বলেন অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা। সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে তিনি এই ভাষণ দেন। তাঁর এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’
ভাষণের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদ এবং গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র, শ্রমিক, জনতার অভ্যুত্থানে নিহত সব শহীদকে সশ্রদ্ধ সালাম ও গভীর শ্রদ্ধা জানান প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে স্মরণ করেন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাঁরা আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, যাঁরা ৯ দফা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, যাঁরা এক দফা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং যাঁরা দেশকে এক হিংস্র স্বৈরাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তাঁদের।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রম করার কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তাঁদের এক কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকারশূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসনও এ সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত এ দেশকে সবাই মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।
আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদের এই ম্যান্ডেট দিয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার শহীদি মৃত্যু হয়। সরকার প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে জোগাড় করছে। এই বিপ্লবে আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৩১ জন। আহত ব্যক্তিদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিনই তালিকায় আরও নতুন নতুন শহীদের তথ্য যোগ হচ্ছে, যাঁরা স্বৈরাচারের আক্রোশের শিকার হয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।’
শুধু জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, গত ১৫ বছরের সব অপকর্মের বিচার করা হবে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন, খুন হয়েছেন এই সময়ে। গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনপ্রধান তাঁকে জানিয়েছেন, অক্টোবর পর্যন্ত তাঁরা ১ হাজার ৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাঁদের ধারণা, এই সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে। অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তাঁরা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কারও সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।’
কেবল দেশে নয়, গুম, খুন ও জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে তাঁর এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে কথা হয়েছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কোনো সদস্য কিংবা অন্য কেউ যাতে হত্যা, গুমসহ এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারেন, সে জন্য গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রতি শহীদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে
গণ-অভ্যুত্থানে সব শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। প্রতিটি শহীদ পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা বুলেটের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তাঁদের চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে কর্নিয়া আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের কোনো শহীদ এবং আহত ছাত্র–শ্রমিক চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা থেকে বাদ যাবেন না—এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকার। এই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ বেশ পাকাপোক্তভাবে তাদের কাজ শুরু করেছে।
পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁরা জনরোষের শিকার হয়েছেন। এতে তাঁদের মনোবল অনেক কমে যায়। পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে তাঁদের আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান উন্নতিও হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও কিছু নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতিতে সহায়তা করেছে।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল, তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে। তাঁরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত একটা দেশ। এ সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে তাঁরা সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যেসব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে, তা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। অল্প যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। সবার সহযোগিতায় দৃঢ়ভাবে এই পরিস্থিতি তাঁরা সামাল দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই নয়, দেশের কোনো মানুষই যাতে কোনোরকম সহিংসতার শিকার না হয়, সে জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং সব সময় সে চেষ্টা করে যেতে থাকবেন।
‘দ্রব্যমূল্য নিয়ে লুকোছাপা নেই’
বন্যাপরবর্তী সময়ে বাজারে শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ফলে আপনাদের কষ্ট হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আমরা সাড়ে ৯ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছি। এ জন্য প্রয়োজনীয় শুল্কছাড়ও দেওয়া হয়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ডিম উৎপাদন করে যাতে সরাসরি বাজারে ডিম সরবরাহ করতে পারে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগগুলো তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ যাতে স্বল্প মূল্যে কৃষিপণ্য কিনতে পারে সে জন্য রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সরকারি কিছু পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি নিম্ন আয়ের ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে ৫৭ লাখকে স্মার্ট কার্ডে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বন্যার ফলে চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও দাম যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের কোনো লুকোছাপা নেই।
ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর। তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত নিচ্ছেন। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব মতামত অনেকাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিটি মতামত সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। আশা করছেন, নির্ধারিত সময়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত আলোচনায় বসবেন। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।
এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা
কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন
সরকার নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তার পর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সব দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ আরও কিছু কাজ শুরু করে দিতে পারবে, যা একটি অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যাতে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে লক্ষ্যেও সরকার কাজ করছে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদের এই ম্যান্ডেট দিয়েছেন। যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম, তারা ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি দেখছেন। কয়েকটি সংস্কার কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে। আমার অনুরোধ, আপনারা এই প্ল্যাটফর্মে উৎসাহ সহকারে আপনাদের মতামত জানাতে থাকুন।’
নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য বিনা দ্বিধায় বলার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার অনুরোধ, সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন। সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনীশক্তি। সংস্কার জাতিকে, বিশেষ করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।’
‘সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন আয়োজনে যে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের সব মানুষের মতামত অপরিহার্য, সেই কমিশন হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশমালার কোন অংশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তার ভিত্তিতে নির্বাচনী আইন সংশোধন করতে হবে। সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা কতটুকু পাব। তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। তত দিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব। আমরা চাইব, যেন এমন একটি নির্বাচনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি, যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করার ব্যাপারে ঐকমত্য গঠনের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে। দেশবাসীর কাছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ক্রমাগতভাবে প্রশ্ন তুলতে থাকতে থাকব, কী কী সংস্কার নির্বাচনের আগে করে নিতে চান। নির্বাচনের আয়োজন চলাকালীন কিছু সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে।
‘সুযোগটা যেন হাতছাড়া না হয়’
নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুদিন পরে চলে যাব। কিন্তু আমাদের মাধ্যমে জাতির জন্য যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হলো, সে সুযোগটা যেন কোনোরকমেই হাতছাড়া করে না দিই, এটার ব্যাপারে দৃঢ় থাকার জন্য আমি দল–মত, নারী-পুরুষ, ধর্ম, তরুণ-বৃদ্ধ, ছাত্র–ব্যবসায়ী, শ্রমিক–কৃষকনির্বিশেষে সবার কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করি, আপনারা আমার এই আবেদন গ্রহণ করবেন।’
এ সময় বিগত মাসে নিয়োগ, পদোন্নতি, অধ্যাদেশ বা আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সফলতার কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘১০০ দিন আগে আর্থিক দিক থেকে আমরা যে লন্ডভন্ড অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটা এখন অতীত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ১০০ দিনে অর্থনীতি সবল অবস্থানে চলে এসেছে। এটা সম্পূর্ণ নিজস্ব নীতিমালা দিয়ে হয়েছে।’
পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে এবং দেশকে মুক্ত রাখার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত সরকার ও তার দোসররা প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ সম্প্রতি এই তথ্য দিয়েছে। পাচার হয়ে যাওয়া এই অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের এই সংকটময় সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের ধন্যবাদ জানান ড. ইউনূস।
এ সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য, অকার্যকর করার জন্য বিশাল অর্থে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এক মহাপরিকল্পনা প্রতিমুহূর্তে কার্যকর রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাদের একটি বড় প্রচেষ্টা হচ্ছে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। পতিত সরকারের নেতারা যারা এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছে, সে অর্থে বলীয়ান হয়ে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। সাবধান থাকুন। তাদের সব হীন প্রচেষ্টাকে ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিন। যেভাবে নস্যাৎ করেছিলেন তাদের বন্দুকের গুলিকে। তাদের আয়নাঘরকে। প্রতি পায়ে তাদের অনাচারের শিকলকে। এ ব্যাপারে সবাই একমত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’