ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হচ্ছে। এতে এমন ব্যবসায়ীদেরও আসামি করা হচ্ছে, যাঁদের রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা নেই।
চাঁদা ও তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ না পেয়ে এবং অনৈতিক সুবিধার জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, মামলায় কারা আসামি হবেন, না হবেন সেটা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি বা দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। আবার কোনো কোনো নেতাকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরাও তাঁদের প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জেই এমন পাঁচটি মামলা পাওয়া গেছে, যাতে অন্তত সাতজন ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। তাঁদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে উপরিউক্ত তথ্য ও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা আড়াইহাজার থানার। মামলা দুটিতে আসামি করা হয়েছে বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের তিনজনকে। তাঁরা হলেন ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। উভয় মামলায় ঢাকার বাইরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়। মামলা দুটির এজাহারের বর্ণনা প্রায় একই। দুই এজাহারেই এসব ব্যবসায়ীর নামের ক্রমিকও একই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফকির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী রয়েছেন। তাঁদের তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা করেও অনেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটি আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির একাধিক পক্ষ এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হয়। একপর্যায়ে আড়াইহাজার এলাকায় প্রভাবশালী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করে বলেও অভিযোগ আছে। এর জেরে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম আড়াইহাজার থানার দুটি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়।
ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের পরিবার কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আমাদের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। আরও মামলায় জড়ানোর হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে।’
মামলা দুটির মধ্যে একটি হলো বিএনপির কর্মী সফিকুল ইসলাম হত্যা মামলা। তাঁকে গত ১৯ জুলাই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর স্ত্রী তাছলিমা আক্তার বাদী হয়ে ২১ আগস্ট আড়াইহাজার থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১৩ নম্বর ক্রমিকে এই চার ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়।
মামলায় এসব ব্যবসায়ীর নাম কে বা কারা দিয়েছেন, সেটা স্বীকার করেননি তাছলিমা আক্তার। তাঁর দাবি, জেনেবুঝেই মামলা করেছেন তিনি।
জুনের মৃত্যুকে আগস্টে হত্যা দেখিয়ে মামলা
আড়াইহাজার থানার অপর মামলাটির খোঁজ নিতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দুপ্তারা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি বাবুল মিয়াকে হত্যার অভিযোগ এনে ২২ আগস্ট মামলাটি করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন।
এতে বলা হয়, ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সচেতন নাগরিক হিসেবে অংশ নেন বাবুল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাড়ি ফেরার পথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবুল মিয়াকে কালীবাড়ি বাজার থেকে উঠিয়ে নিয়ে দুপ্তারা ঈদগাহ মাঠে হত্যা করা হয়।
অথচ বাবুলের মৃত্যুসনদ ও স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মারা গেছেন ৩ জুন। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপির মহাসচিব তখন শোকবার্তাও পাঠিয়েছিলেন।
নিহত বাবুলের পরিবার ও এলাকাবাসী জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর ছোট ভাই নাজমুল হোসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা বাবুলকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর ৩ জুন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
৩ জুন উপজেলার গিরদা-পশ্চিমপাড়া-চৌধুরীপাড়া কবরস্থানে বিএনপির নেতা বাবুলের মরদেহ দাফন করার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক সেলিম মিয়া।
কেবল তা–ই নয়, ৩ জুন ৪৯ বছর বয়সী বাবুলের মৃত্যু হয়েছে বলে মৃত্যুসনদ প্রদান করেছে রূপগঞ্জের ভুলতায় এলাকায় অবস্থিত ডিকেএমসি হাসপাতাল লিমিটেড।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সাজানো মামলা করতে রাজি হয়নি বাবুলের পরিবার। এ কারণে পরিবারটির কাউকে মামলায় সাক্ষীও করা হয়নি।
গত শুক্রবার বাবুল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। মামলা ঘিরে জটিলতার কারণে তিনি রূপগঞ্জের ভুলতায় বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। আড়াইহাজারের বাড়িতে কথা হয় বাবুলের বড় ভাই আবদুল বাতেনের স্ত্রী নাসিমা জাফরিনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দেবর হত্যার সঙ্গে ১০–১১ জন জড়িত। কিন্তু মামলায় যাঁরা জড়িত নন, এমন ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। তাঁরা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চান।
তবে বাবুল হত্যা মামলার বাদী বিএনপির নেতা নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, দলের সিদ্ধান্তে মামলাটি করা হয়েছে।
বাবুলের মৃত্যু হয়েছে ৩ জুন। মামলায় বলা হয়েছে ৪ আগস্ট হত্যা করা হয়েছে—এর কারণ জানতে চাইলে নুরুল আমিন বলেন, কোনো ভুলভ্রান্তি থেকে থাকলে সেটা দেখতে হবে।
এ বিষয়ে আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এহসান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, থানায় অভিযোগ নিয়ে আসায় এজাহার গ্রহণ করা হয়েছে। নিরপরাধ কেউ থেকে থাকলে সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
আরও ব্যবসায়ী আসামি
৫ আগস্ট হাফেজ সোলাইমান নিহত হওয়ার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আরএস নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সহসভাপতি মোরর্শেদ সারোয়ারকেও আসামি করা হয়।
মোরশেদ সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কখনো রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। কী কারণে আমাকে এ হত্যা মামলায় জড়ানো হলো, তা বুঝতে পারছি না।’
একইভাবে ফতুল্লা থানার একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে ভুঁইগড়ের এসবি স্টাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না, ব্যবসায়ী। মামলার বিষয়টি আমি অবগত নই।’
অন্যদিকে এক বছর আগের একটি মারপিটের ঘটনায় জনৈক নাজমুল ইসলাম রনি ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ ১৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় ভাই ভাই স্পিনিং মিলের মালিক লাক মিয়াও আসামি।
এ ছাড়া ১৯ জুলাই বাড্ডায় তৌফিকুল ইসলাম নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয় ২১ আগস্ট। বাড্ডা থানার এ মামলায় ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ও উত্তরার ব্যবসায়ী শেখ মো. রুহুল আমিনের নামও রয়েছে। তাঁদের আসামি করার নেপথ্যে সোনা চোরাচালান ও রাজউকের প্লট জালিয়াতির ঘটনায় আলোচিত হওয়া এক ব্যক্তি।
রুহুল আমিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। মামলার বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে হয়রানির করার উদ্দেশ্যে আসামি করা হয়েছে। একটি চক্র কিছুদিন ধরে তাঁকে হুমকি দিচ্ছিল, এই পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর দেশে একধরনের সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রতিশোধমূলক বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে সেটাও অপরাধ। এটি ছাত্র–জনতার নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে যায় না। তিনি বলেন, এ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।