সূর্যের রহস্য উন্মোচনে বাংলাদেশের পদার্থবিদের অভিনব সাফল্য
সূর্য—আমাদের সৌরজগতের প্রাণভোমরা। তার আলোর মাঝেই পৃথিবীর সব প্রাণ এবং প্রকৃতি জীবিত থাকে। সূর্য, এক বিশাল নক্ষত্র, যা মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের সমন্বয়ে তৈরি একটি বল। প্রতিনিয়ত তার কেন্দ্রে পারমাণবিক সংযোজন প্রক্রিয়া চলছে, যা তৈরি করে বিপুল পরিমাণ শক্তি। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এত উত্তপ্ত পরিবেশে সূর্যের ছবি তোলা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশের পদার্থবিদ মুনীম হোসেন রানা এই চ্যালেঞ্জটি জয় করেছেন। সম্প্রতি তিনি সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার এবং ফটোস্ফিয়ার স্তরের ছবি তুলেছেন এবং তার অভিজ্ঞতা *প্রথম আলো*কে জানিয়েছেন।
**সূর্যের গঠন ও স্তর**
দূর থেকে সূর্য একটি একক গোলক মনে হলেও, এর অভ্যন্তরে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর। মুনীম হোসেন রানা বলেন, “সূর্য নিয়ে আমাদের ধারণা সীমিত। সূর্যের কেন্দ্রে (কোর) পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া চলমান, যা শক্তির মূল উৎস। এখানে তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর আছে রেডিওঅ্যাকটিভ জোন, যেখানে শক্তি ধীরে ধীরে ফোটনের আকারে স্থানান্তরিত হয়। তার পর আসে কনভেকটিভ জোন, এরপর ফটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার, এবং সর্বশেষ করোনা, যা সূর্যের বাইরের স্তর।”
সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১০,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৫,৫৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস), যা তুলনামূলকভাবে কম, তবে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত তাপমাত্রায় সূর্যের ছবি তোলা খুবই কঠিন। তবে, মুনীম হোসেন রানা তার দক্ষতা এবং উচ্চমানের যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই চ্যালেঞ্জে সফল হয়েছেন।
**ছবি তোলার অভিজ্ঞতা**
মুনীম হোসেন একজন শৌখিন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার। চলতি বছরের ৮ এপ্রিল তিনি *দ্য গ্রেট আমেরিকান এক্লিপ্স* নামের সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের করোনার ছবি তুলেছিলেন। এর পর থেকে সূর্যের ছবি তোলার প্রতি তার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তিনি বলেন, “সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে আমি সূর্যের ছবি তোলা শুরু করি। বেশ কয়েকটি ছবি তুলেছি, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি আমি ৬ নভেম্বর তুলি।”
মুনীম হোসেন তার টেক্সাসের বাড়ির পেছনের আঙিনা থেকে সূর্যের ছবি তুলেছেন। তিনি একটি বিশেষ সোলার টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছেন, যার নাম *করোনাডো সোলার ম্যাক্স থ্রি আর ডাবল স্ট্যাক*। এই টেলিস্কোপে ব্যবহৃত ছিল হাইড্রোজেন আলফা ফিল্টার, যা সূর্যের পৃষ্ঠের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য যেমন সানস্পট, ফিলামেন্ট এবং প্রমিনেন্স দেখতে সহায়তা করেছে।
“আমি *প্লেয়ার ওয়ান মার্স এম* ক্যামেরা দিয়ে উচ্চ রেজল্যুশনে ছবি তুলেছি। শার্প ক্যাপ প্রো সফটওয়্যার দিয়ে ছবিগুলি প্রক্রিয়া করেছি, এবং ৩০০০ ফ্রেম অটো স্ট্যাকার্ট দিয়ে স্ট্যাক করা হয়েছে। এর ফলে ছবির স্বচ্ছতা ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়,”—বলেছেন মুনীম।
**সূর্যের ছবি তোলার চ্যালেঞ্জ**
সূর্যের ছবি তোলা অত্যন্ত কঠিন। সূর্য থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয়তা এবং তাপ নির্গত হয়, তাই খালি চোখে কিংবা সাধারণ ক্যামেরায় সূর্যের দিকে তাকানো বিপজ্জনক। মুনীম হোসেন বলেন, “সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে চোখের ক্ষতি হতে পারে এবং সাধারণ ক্যামেরার সেন্সরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সূর্যের ছবি তুলতে বিশেষ ধরনের সোলার টেলিস্কোপ, ফিল্টার এবং ক্যামেরা প্রয়োজন।”
তিনি আরও জানান, সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার এবং ফটোস্ফিয়ার স্তরের ছবি তোলার সময় সূর্যের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরের বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। “ক্রোমোস্ফিয়ার সূর্যের বাইরের গোলাপি-লাল রঙের স্তর, যা সাধারণত দেখা যায় না। তবে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় এটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়,”—বলেন মুনীম।
**সূর্যের বর্তমান সক্রিয়তা**
সূর্য প্রতি ১১ বছর পর এক চক্র সম্পূর্ণ করে, যা সৌরচক্র হিসেবে পরিচিত। এই সময় সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে এবং সৌর ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায়। “এই সময় সূর্য থেকে সৌরঝড়ের প্রভাব পৃথিবীতে দেখা যায়। সৌরঝড় সৌর বিস্ফোরণ এবং সৌরশিখার ছোটাছুটি। এই সময় সূর্যের পৃষ্ঠে সানস্পট বা সৌরকলঙ্ক বৃদ্ধি পায়,”—জানান মুনীম।
তিনি বলেন, “এবারের সৌরচক্রে সবচেয়ে বেশি অরা দেখা যাচ্ছে, যা পৃথিবীর দুই মেরুর আশপাশে চমকপ্রদ আলোকঝলক তৈরি করছে। এই ঝলক দেখার জন্য আমি সূর্যের ছবি তুলেছি, যা একটি অদ্ভুত এবং বিরল অভিজ্ঞতা।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই, মুনীম হোসেন তার সূর্যের ছবির মাধ্যমে আমাদের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। সূর্য যে শুধুমাত্র জীবনের উৎস নয়, তার গহিন রহস্যও একটি বিস্ময়ের বস্তু—এমনটাই প্রমাণিত হলো তার এই চমকপ্রদ কাজের মাধ্যমে।