**ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের জন্য পরিবারে উৎকণ্ঠা ও সহায়তার অভাব**
গত কয়েক মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন বহু ছাত্র-জনতা। তাদের মধ্যে অনেকেই হারিয়েছেন হাত-পা, চোখ, বা গুরুতর আহত হয়েছেন শরীরের অন্যান্য অংশে। এই আহতদের মধ্যে অনেকের জন্য জীবন এখন এক কঠিন সংগ্রাম। চিকিৎসার খরচ, পরিবারের খরচ চালানো—সবকিছু নিয়েই তাঁদের পরিবারে চলছে অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা। প্রথম আলো তাদের কিছু পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা এখনও সরকারি বা অন্য কোনো সহায়তা পাননি।
**ইনামুল কাওছার: পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি**
ইনামুল কাওছার (৩২) ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা বাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেন। পুলিশের গুলিতে তাঁর ডান হাঁটুতে গুরুতর আঘাত লাগে, যা শেষপর্যন্ত হাঁটু কেটে ফেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বর্তমানে পঙ্গু, ঘরবন্দী। তার স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান, অসুস্থ মা এবং ছোট ভাইয়ের উপরেই এখন পুরো সংসারের দায়িত্ব। এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ইনামুল, কিন্তু এখন চিকিৎসার খরচ ও সংসারের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে কষ্ট হচ্ছে।
**গুলি পেয়ে চোখ হারানো শুভ**
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র মো. শুভ হোসেন (২২) ১৬ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেয়ার সময় পুলিশের গুলিতে ডান চোখে গুরুতর আঘাত পান। প্রথমে অস্ত্রোপচার হলেও চোখের ভিতরে গুলি রয়ে যায়। বর্তমানে তাঁর চোখে দেখার সম্ভাবনা কম, এবং পরবর্তী অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া চলছে। শুভ বর্তমানে কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য ধারদেনা করে খরচ চালাচ্ছেন। শুভর বাবা প্রবাসী, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা উপার্জনের উপায় হিসেবে তাঁকে সাহায্য করছেন।
**হামজা: চোখের ক্ষতি ও আর্থিক সংকট**
১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জে গুলি খেয়ে ডান চোখে গুরুতর আঘাত পান হামজা (২২)। চিকিৎসকদের মতে, তিনি আর সেই চোখে দেখতে পাবেন না। চোখের চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ হলেও এখন পর্যন্ত কোনও সরকারি সহায়তা পাননি হামজা। তাঁর পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র, এবং বর্তমানে তারা দুই দফা অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা এবং সংসারের খরচের জন্য অসহায় হয়ে পড়েছে।
**মেরাজ উদ্দিন: চোখে গুলি ও কঠিন সংগ্রাম**
মেরাজ উদ্দিন (২৩) ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি ৫ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন। তাঁর মাথায় চারটি গুলি আটকে গেছে, এবং দুটি গুলি তাঁর ডান চোখের ভিতর রয়েছে। বর্তমানে তিনি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও ঢাকার সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন। চিকিৎসার জন্য প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা এখনো পায়নি।
**আরিফুল ইসলাম: আন্দোলনকারী পঙ্গু হয়ে গেছেন**
কুড়িগ্রামের আরিফুল ইসলাম (২৮) ২০ জুলাই ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। সেখানে পুলিশ গুলিতে আহত হয়ে তিনি কোমরের নিচে গুরুতর আঘাত পান, এবং বর্তমানে ক্রাচে ভর দিয়ে চলাচল করেন। তাঁর বড় ভাই জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন কিছু সহায়তা করেছে, কিন্তু এখনও আরিফুলের চিকিৎসা ও সংসার চালানোর সমস্যা রয়ে গেছে।
**শুভ মিয়া: পা হারানোর কষ্ট**
কিশোরগঞ্জের শুভ মিয়া (২১) ৪ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পুলিশ গুলিতে তাঁর দুটি পা গুরুতরভাবে আহত হয় এবং তা শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় শুভ এবং তাঁর পরিবার শঙ্কায় আছেন। তাঁর মা একটি রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজ করেন, আর শুভও সেখানেই কাজ করতেন, কিন্তু বর্তমানে শরীরের অবস্থা এমন যে, তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এই সব ঘটনায় আহতরা এবং তাঁদের পরিবারে তৈরি হয়েছে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। তাঁদের চিকিৎসা খরচ ও সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়ার মতো কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। কিছু পরিবার কিছু সহায়তা পেলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ আহতদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। পরিবারগুলোর দাবি, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত আহতদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে, যেন তারা সুস্থ হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে।