রাজনৈতিক অস্থিরতার ধকল কাটাতে পারছে না রাজস্ব খাত। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিথিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে এ চিত্র উঠে এসেছে। জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—কোনো মাসেই মাসওয়ারি শুল্ক-কর আদায় করা সম্ভব হয়নি। প্রতি মাসেই আদায়ের লক্ষ্য থেকে বেশ পিছিয়ে ছিল এনবিআর।
জুলই মাসে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গণ-আন্দোলনের সময় দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউ ছিল বেশ কয়েক দিন। এ সময় কলকারখানা ও সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকে। এসবের প্রভাব পড়ে শুল্ক-কর আদায়ে। গত ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠিত হলেও নানা ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ছিল। বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি দাবিদাওয়া নিয়ে মাঠে নামে। ফলে অস্থিরতার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলে জানিয়েছেন শুল্ক-কর কর্মকর্তারা।
আমরা জানি কেন ঘাটতি হয়। অতীতের সরকার প্রতিবছর বাজেট বড় করেছে। বাজেটের অর্থ জোগানের হিসাব মেলাতে এনবিআরের ওপর অযৌক্তিকভাবে বিশাল লক্ষ্য দিয়েছে। এ জন্য লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
এনবিআরের হিসাব অনুসারে, গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে তাদের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ১১২ কোটি টাকা। তবে এই সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ওই চার মাসে সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, ভ্যাটের রিটার্ন জমা দেওয়ার পর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন ঘাটতি কমে আসবে।
এনবিআরের তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম চার মাসের তুলনায় এবার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সব মিলিয়ে ৯৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল। অর্থাৎ এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন, বছরের শেষের দিকে কর আদায়ে গতি বাড়বে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান সরকার গঠিত রাজস্ব খাত সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট আদায় বিঘ্ন ও আয়কর কম আদায় হওয়ার জন্য জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করেন। তিনি প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘আমরা জানি কেন ঘাটতি হয়। অতীতের সরকার প্রতিবছর বাজেট বড় করেছে। বাজেটের অর্থ জোগানের হিসাব মেলাতে এনবিআরের ওপর অযৌক্তিকভাবে বিশাল লক্ষ্য দিয়েছে। এ জন্য লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বেশি জরুরি হলো, রাজস্ব আদায়ে আগের বছরের চেয়ে বাড়ল কি না।’
শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর—সব খাতেই পিছিয়ে
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর—এর কোনোটিতেই খাতওয়ারি লক্ষ্য পূরণ হয়নি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি আয়কর খাতে। এই খাতে চার মাসে ঘাটতি ছিল ১২ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার মতো। আয়কর খাতে ৪৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য থাকলেও পাওয়া গেছে ৩২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা।
চার মাসে আমদানি খাতে ৩৯ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে ৩২ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই খাতে ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। গত জুলাই-অক্টোবরে ভ্যাট খাতে ঘাটতি ছিল ১১ হাজার ১০২ কোটি টাকা। ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩৬ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এই সময়ে এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, রাজস্ব আদায়ে করদাতাদের বিদ্যমান সমস্যার পাশাপাশি কর আহরণকারীর দিক থেকে কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা-ও চিহ্নিত করবে রাজস্ব খাত সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটি। সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে কাজ করছে কমিটি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এনবিআর কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে। এতে বাড়তি শুল্ক-কর আদায় হবে। এ ছাড়া নানামুখী সংস্কার কার্যক্রমের সুফলও শিগগির মিলবে।