মাঠে অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের কাজ করেছে তাঁর পা। কখনো সুরে অথবা ছন্দে, আবার কখনো বুদ্ধির ঝিলিক খেলেছে তাতে। বিনি সুতোয় গাঁথা পাসের পর পাসে গত মৌসুমে ফুটবলের মাঠ তাঁর কাছে যেন নকশিকাঁথা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্যারিসে থিয়েটার দু শাতলেতে রদ্রিকে যেভাবে দেখা গেল, সবাই তা জানলেও কেউ-ই সম্ভবত তাঁকে ওভাবে দেখতে চাননি।
অভ্যাগতদের আসন থেকে রদ্রি উঠে দাঁড়ালেন। পাশের জন ক্রাচটা ধরিয়ে দিলেন। রদ্রি ক্রাচে ভর রেখে ধীরে ধীরে রওনা দিলেন ব্যালন ডি’অর মঞ্চে। যেতে যেতে মৃদু হাসিও ফুটল। না জেনেই বলে দেওয়া যায়, হাসিটা সংক্রমিত হলো স্পেনে। ক্রাচের ওই লোকটির জন্য যে ৬৪ বছর পর ব্যালন ডি’অর জিতলেন কোনো স্প্যানিশ!
সংক্রমণ ততক্ষণে পাশের দেশ ইংল্যান্ডেও ছড়িয়েছে। ম্যানচেস্টারের নীল অংশে। ব্যালন ডি’অর ট্রফির উষার সোনালি ছটা সেখানকার আকাশের নীলে কখনো মেশেনি। রদ্রিই প্রথম, রদ্রিতেই প্রথম!
‘দ্য গোল্ডেন গ্যালিসিয়ান’—লুইস সুয়ারেজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৮৯। এ বয়সে করতালি দিতেও হয়তো তাঁর কষ্ট হতো। হয়তো তা পাত্তাও দিতেন না। তাঁর হাত ধরে স্পেন প্রথম ব্যালন ডি’অর জিতেছিল সেই ১৯৬০ সালে। আহা, গত বছর জুলাইয়ে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমানো সুয়ারেজ রদ্রির অর্জনটা দেখে যেতে পারলেন না!
আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই। লোকে আমাকে তেমন একটা চেনে না। আমি সাধারন একজন। খেলা উপভোগ করি। নিজের কাজটাও। ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি। শান্ত মানুষ।
নিজেকে নিয়ে ব্যালন ডি’অর মঞ্চে রদ্রি
কে জানে, অন্যলোক থেকে হয়তো ঠিকই থিয়েটার দু শাতলেতে চোখ রেখে ‘চিয়ার্স’ করেছেন সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে। প্যারিসের জমকালো মজলিশে জর্জ উইয়াহর কাছ থেকে রদ্রি ছেলেদের ব্যক্তিগত সেরার এই পুরস্কার যখন নিচ্ছিলেন, তখন আপনার চোখ চলে যেতে পারে অভ্যাগতদের মধ্যে উপস্থিত লুইস দে লা ফুয়েন্তের ওপর।
ভদ্রলোক স্পেনের কোচ। গত জুলাইয়ে স্পেন ইউরো জেতার পর বলেছিলেন, ব্যালন ডি’অরটা এখনই রদ্রিকে দিয়ে দেওয়া হোক। তাতে ব্রাজিলের সমর্থকেরা হয়তো একগাল হেসেছিলেন। কারণ, প্রায় আর সবার মতোই তাঁদেরও ভাবনা ছিল, এবার ব্যালন ডি’অরে ‘ইশকাপনের টেক্কা’ তো তাঁদের ঘরের ছেলে ভিনিসিয়ুস। ফুয়েন্তে দিতে বললেই দিতে হবে নাকি!
তা হবে না এবং তেমন কিছু হয়ওনি। ছেলেদের বর্ষসেরার এই পুরস্কারে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০ দেশের প্রতিটি থেকে একজন করে সাংবাদিক ভোট দিয়েছেন। তাতে রদ্রির ব্যালটেই সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ায় ভিনিসিয়ুসের ভক্তদের আসলে হাহুতাশ কিংবা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব খোঁজা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কয়েক দিন ধরে ব্যালন ডি’অর ও ভিনিকে নিয়ে যেসব গল্পগাথা সবাই ভেবে রেখেছিলেন, সেসব ভোটের ব্যালটে মুছে সাংবাদিকেরা আসলে থিয়েরি অঁরির কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করলেন। কয়েক দিন আগে সিবিএস স্পোর্টসকে ফরাসি কিংবদন্তি বলেছিলেন, তিনি রদ্রির হাতে ব্যালন ডি’অর দেখতে চান। কিন্তু ভিনিসিয়ুসকে পুরস্কারটি জয়ে এগিয়ে রেখে আক্ষেপ ঝরেছিল তাঁর কণ্ঠে, ‘লোকে মিডফিল্ডারদের ভুলে যায়। তারা দলের হৃদয়। সে ম্যানচেস্টার সিটির হৃদয়।’
অঁরির কথাটা আংশিক ভুল। রদ্রি শুধু সিটি নয়, স্পেনেরও হৃৎকমল। স্পেনের ইউরোজয়ের ‘নিউক্লিয়াস’—যার ভূমিকাটা ঠিক পরিসংখ্যানে টের পাওয়া যায় না খেলা না দেখলে। কিন্তু নির্বাচকেরা সেই ভুল করেননি। ২৮ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের হাতে তাঁরা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পুরো টুর্নামেন্টে ৫২১ মিনিট (প্রতি ম্যাচে গড়ে ৮৬.৮৪ মিনিট) খেলে সফল পাসের হার ছিল প্রায় ৯৩ শতাংশ (৪৩৯ পাসের মধ্যে ৪১১টি সফল পাস)। যে একটি গোল করেছিলেন, শেষ ষোলোয় জর্জিয়ার বিপক্ষে সেই গোল জাগিয়ে তুলেছিল স্পেনকে। আর ওই যে অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের কথা বলা হলো, রদ্রি ঠিক এ কাজটাই করেছেন পুরো টুর্নামেন্টে। ‘পাপেট শো’র মতো পুরো দলের খেলা নিয়ন্ত্রণ করেছেন পেছন থেকে। অনেকটাই পর্দার আড়ালে অক্লান্তভাবে নিজের কাজ করে যাওয়ার গুণপনাটুকুই তাঁকে আজ তুলে আনল এতটা সামনে। অন্য অর্থে সবার ওপরে।
রদ্রির হাতে ব্যালন ডি’অর দেখে পেপ গার্দিওলাও নিশ্চয়ই একগাল হেসেছেন। গত মৌসুমে সিটির হয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ রক্ষণ ও আক্রমণের মাঝে সূত্রধরের ভূমিকায় ছিলেন রদ্রি। স্পেনের হয়েও তা–ই। যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, দেখে মনে হয়েছে নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তার মিশ্রণে তৈরি কোনো ‘মেশিন’—যে ব্যাকলাইন থেকে আক্রমণ তৈরি করে আক্রমণেও ওঠে এবং বল হারালেও প্রতিপক্ষের চেয়ে দ্রুতগতিতে রক্ষণে নামতে এবং বল কেড়ে আবারও ফিরে যায় শুরুতে—আক্রমণ তৈরি! গত মৌসুমে ম্যাচের পর ম্যাচ পৃথিবী দেখেছে এই রদ্রিকে। তাতে গত মৌসুমে টানা চতুর্থবারের মতো লিগও জিতেছে সিটি। শুধু তা–ই নয়, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপাও অন্য কেউ নিতে পারেনি।
রদ্রির কাছে আরও একটি সংখ্যা আছে। যেটি এমন কচকচে নয়, মিষ্টি। ব্যালন ডি’অর মঞ্চ থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ‘জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ মানুষকে। প্রেমিকা লরা সামনেই ছিলেন। রদ্রি জানিয়েছেন, আজ তাঁদের অষ্টম বার্ষিকী। আর এমন দিনেই কি না প্রেমিকাকে সামনে রেখে সবাইকে বাধ্য করলেন তাঁকে সেরা ঘোষণা করতে!
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল লিগে ১৭টি গোলে (৮ গোল ও ৯ অ্যাসিস্ট) সরাসরি অবদান যাঁর, তাঁকে আপনার পছন্দ না-ই হতে পারে; কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না। ঠিক যেভাবে পরিসংখ্যান দেখেও অস্বীকার করা যায় না, গত মৌসুমে ভিনিসিয়ুস রিয়ালকে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগা জেতাতে বড় ভূমিকা রাখলেও ফুটবল-মস্তিষ্ক বলবে রদ্রির নাম। ভিনিসিয়ুসের ফরোয়ার্ড হয়ে যেখানে ৪৯ ম্যাচে ২৬ গোল, রদ্রির সেখানে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়ে ৬৩ ম্যাচে ১২ গোল। এই গোলগুলোর সময় ও প্রয়োজন স্পেন ও সিটির জন্য কেমন এবং কতটা ছিল, জিজ্ঞেস করতে পারেন দে লা ফুয়েন্তে ও গার্দিওলা। একজন তো ব্যালন ডি’অর আগেই দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, আরেকজনের (গার্দিওলা) চোখে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডার।
সেই মিডফিল্ডার হিসেবেই গত মৌসুমে রদ্রি গোল বানিয়েছেন যেখানে ১৪টি, ভিনির ১১টি। তাঁর ‘কি পাস’ ১০০টি, ভিনির ৭০টি; চাইলে এভাবে আরও পরিসংখ্যান দেওয়া যায়। গোলের ১১টি সুযোগ তৈরি করা রদ্রি এমন সুযোগ পেয়ে ব্যর্থ চারবার। ভিনি ১৯ বার গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন বটে; কিন্তু এমন সুযোগ থেকে গোল করতে ব্যর্থ ২৬ বার।
আরও একটি সংখ্যা আছে। যেটি এমন কচকচে নয়, মিষ্টি। রদ্রি ব্যালন ডি’অর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ‘জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ মানুষকে। প্রেমিকা লরা সামনেই ছিলেন। তাঁর সামনেই বললেন, আজ তাঁদের অষ্টম বার্ষিকী। এমন দিনে প্রেমিকার সামনে সবার কাছ থেকে আদায় করলেন সেরার স্বীকৃতি। লরার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, মুহূর্তটা মিষ্টি না লেগে পারে-ই না। আর রদ্রির কাছে? ‘অবিশ্বাস্য এক রাত।’
যে রাতটা রদ্রির কাছে হয়তো ঠিক স্বাভাবিক নয়। ১৮ বছর আগে সেই ফাবিও কানাভারোর পর প্রথম ডিফেন্সিভ খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অর জিতলেও সব আলো তাঁর ওপর পড়বে কেন? মাঠে তো এমন হয়নি কখনো! এসব রাতের সঙ্গে যেসব তারকা পরিচিত কিংবা অভ্যস্ত রদ্রি ঠিক তেমন ধাঁচের নয়। সেরার মঞ্চে দাঁড়িয়েও রদ্রির মুখ ফুটে তাই বের হয়, ‘আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই। লোকে আমাকে তেমন একটা চেনে না। আমি সাধারন একজন। খেলা উপভোগ করি। নিজের কাজটাও। ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি। শান্ত মানুষ।’
ধাঁচটা কি বোঝা গেল? হ্যাঁ, মাঠের জায়গাটুকুর মতোই। পেছন থেকে নীরবে-নিভৃতে আপন মনে নিজের কাজটা করে যাওয়ার যে শান্তি, ওটাই রদ্রির পৃথিবী।
সেই ‘পৃথিবী’টা আজ সবার সামনে স্বীকৃতি পেল, এতটুকুই যা!