১০ বছর আগে তাজুল ইসলাম দেশ ছেড়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় বসবাসরত তাজুল এবার বিশেষ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। কী সেই উদ্দেশ্য? জানতে চাইলে মুচকি হেসে বললেন, “বিয়ের বয়স হয়েছে তো!” ৩০ বছর বয়সী তাজুল এবার দেশে এসেছেন ‘রিটার্ন টিকিট’ কেটে নয়। কত দিন লাগবে, কী করতে হবে, সেটা বুঝে ফেরার টিকিট কাটবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু দুই মাস আগে দেশে এসে দেখেন, সারা দেশে অস্থিরতা। এরই মধ্যে সরকার পরিবর্তন হলো। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তাজুল ভেবেছিলেন দ্রুতই চলে যাবেন, এমনকি লাগেজও গুছিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আগস্টের শেষে এসে আরেক বিপদের মুখে পড়লেন।
বন্যার পানিতে যে কোনো দিন ঘরবাড়ি ডুবে যেতে পারে, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। তাজুলদের গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষও এমন ভয়াবহ পানি কোনো দিন দেখেননি। ফেনী জেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের ভগবানপুর গ্রামে তাজুলের বাড়ি। এই গ্রামে ৭০টি পরিবারের বাস। গত ২৮ আগস্ট তাজুলের সঙ্গে দেখা হলো। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে বিরলী বাজারের কাছে হাঁটুপানিতে আমাদের ত্রাণের ট্রাক থামানো। নৌকা নিয়ে এসে থামলেন তাজুল ও কাওসার। তাজুলের নৌকা চালানোর কায়দা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এর আগে কোনো দিন তিনি নৌকা চালাননি। তাঁদের নৌকায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ত্রাণসামগ্রী তুলে ভগবানপুর গ্রামের দিকে রওনা হলাম। নৌকায় যেতে যেতে গল্প জমে উঠল।
তাজুল বললেন, এই এক সপ্তাহ ধরে নৌকা চালাতে চালাতে এখন তিনি অনেকটাই দক্ষ হয়ে উঠেছেন। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করেন। অনেকে প্রবাসীও। কিন্তু সেখানকার বিলে সাধারণত পানি জমে না, তাই কৃষিকাজে নৌকার দরকার হয় না। তাহলে এই নৌকা এল কোথা থেকে? জানতে চাইলে তাজুল বলেন, “আমাদের গ্রামে কিছু জেলে পরিবার আছে, যারা নদীতে মাছ ধরে। তাঁদেরই একজনের নৌকা। এমন দুই-তিনটা ছোট ডিঙি নৌকা আছে জেলেদের কাছে। বন্যার পর সেগুলো তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে আমরা পুরো গ্রামের কাজে লাগাচ্ছি।”
আমরা গল্প করতে করতে নৌকা এগিয়ে চলে। তাজুল ও কাওসার দক্ষ হাতে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন। বন্যার পানিতে থইথই বিল। বিলে সদ্য লাগানো ধানের চারা এখন মানুষের সমান পানির নিচে তলিয়ে আছে। এই বিল পার হয়ে আরও একটি বিল পেরোলেই তাঁদের গ্রামে পৌঁছানো যাবে। এতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে। পানির কারণে গ্রামটি এখন দূরের পথ হয়ে উঠেছে।
সড়কপথ বিচ্ছিন্ন থাকায় কোনো সংগঠনই সেখানে ত্রাণ নিয়ে যেতে পারছে না। বন্যার পানি গ্রামে ঢোকার পর তাজুল ভেবেছিলেন, তিনি দ্রুত বিদেশে ফিরে যাবেন। লাগেজ তো গোছানোই আছে! তবে রাতে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাল।
“নিজের পরিবার তো বটেই, পুরো গ্রামকে পানির মধ্যে রেখে চলে যেতে মন সায় দিল না,” বললেন তাজুল। দুই দিন পানিবন্দী থাকার পর তাজুল ভাবলেন, গ্রামের জন্য কিছু একটা করা উচিত। এভাবে চলতে থাকলে অনেক পরিবারই না খেয়ে থাকবে। সমবয়সী কয়েকজন তরুণকে ডেকে প্রথম দুই দিন শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করেন। কিরণ, জায়েদ, নোবেল, সাগর, ফাহিম, মাহিরসহ অনেক তরুণই এগিয়ে আসেন। তাঁরা বসে পুরো গ্রামের সব পরিবারের নাম লিখে রাখেন। এরপর নানা দিকে ত্রাণের খোঁজে ছুটতে শুরু করেন। তাঁদের এই ছোটাছুটির কাজে জেলেপাড়ার নৌকাগুলো বেশ কাজে দেয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, “প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না কী করব। পরে নিজের পরিচিতদের বলতে শুরু করলাম, আমাদের গ্রামে ত্রাণ পাঠান। কেউ আসতে পারছে না, তাই আমরা নিজেরাই নৌকা নিয়ে তাঁদের কাছে যাচ্ছি।” বিলের মাঝ থেকে দূরের একটি বিদ্যুৎ স্টেশন দেখিয়ে তাজুল বলেন, “ওখানে অনেক চায়নিজ কাজ করেন। তাদের মধ্যে এক ইঞ্জিনিয়ার আছেন আমার পরিচিত। তাঁকে জানালে গ্রামের জন্য তাঁরা এক দিনের ত্রাণ দেন। এক জায়গা থেকে রান্না করা বিরিয়ানি আসে। এভাবেই যেখান থেকে যা পাচ্ছি, পুরো গ্রামে বণ্টন করছি।”
প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ দেওয়ার জন্য নানাভাবে যোগাযোগ করছিলেন, তখন স্থানীয় সাংবাদিক শাহজালালের মাধ্যমে এই গ্রামের খোঁজ মেলে। গল্প করতে করতে আমরা গ্রামের প্রবেশমুখে খালপাড়ের একটি কালভার্টের কাছে এসে পৌঁছাই। আগে থেকেই সেখানে আরেকদল তরুণ অপেক্ষায় ছিল। কীভাবে কী বণ্টন করতে হবে, তাঁদের নির্দেশনা দিলেন তাজুল। তাজুল বললেন, “আপনাদের আগে জেলেপাড়ায় নিয়ে যাই। সেখানে ১২টি পরিবার আছে। সেখান থেকেই আমরা ত্রাণ দেওয়া শুরু করতে পারি।”
আমাদের নৌকা জেলেপাড়ার গোয়ালঘর, ডুবে থাকা নলকূপ, রান্নাঘর পেরিয়ে রুপালি বর্মণের বাড়িতে এসে থামে। দুই দিন আগে তাঁর শাশুড়ি মারা গেছেন। ৮০ বছর বয়সী বৈষ্ণব প্রিয়বালা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। পানির কারণে হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে যায়। সৎকার কোথায় করেছেন? পানিঘেরা প্রিয়বালার টিনের ঘরটি দেখিয়ে বলেন রুপালি। বাড়িটির চারদিকে তখনো পানি। মাটির মেঝে থেকে পানি নেমে গিয়ে সারা ঘর কাদায় ভরে আছে। সেই ঘরের ভেতরেই প্রিয়বালাকে সমাহিত করা হয়েছে। সমাধির পাশে একটি তুলসীগাছ।
এই পাড়ার অন্য পরিবারগুলো একটি পাকা ঘরে গাদাগাদি করে আছেন। কয়েকজন বাড়ির ছাদে ত্রিপল ঘিরে থাকছেন। পথের ধারে পড়ে থাকা চার বছরের পুরোনো একটি গাছের কারণে পুরো গ্রামের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রথম দিনেই। এই পাড়া থেকে বেরিয়ে আমরা গ্রামের অন্য এলাকায় গেলাম। বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছানো হলো। বেশির ভাগ বাড়ি তখনো পানিতে অর্ধেক ডুবে আছে। কেউ খাটের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন, কেউবা বাড়ির ছাদে। অনেক বাড়িতে এক ঘরে অনেকগুলো পরিবার।
ত্রাণ বিতরণের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগে আমরা মূল সড়কের ট্রাকের দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সঙ্গে নৌকায় তাজুলসহ আরও কয়েকজন তরুণ। বিরলী বাজার থেকে তাঁরা এক বোতল ডিজেল কিনে গ্রামে ফিরবেন। কারণ, বিদ্যুৎ না থাকলেও জেনারেটর চালিয়ে গ্রামের মোবাইলগুলো সচল রাখার ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা, যাতে দেশে-বিদেশে থাকা এই গ্রামের অন্যরা পরিবারগুলোর খোঁজ রাখতে পারে।